ঘরবন্দি শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য

দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থেকে শিশুর মানসিক অবস্থা খুব নাজুক হয়ে পড়েছে। তাই এ সময় শিশুর দিকে দিতে হবে বাড়তি মনোযোগ। মা-বাবার পাশাপাশি পরিবারের সবাইকে শিশুর সঙ্গে অর্থবহ সময় কাটাতে হবে। নিতে হবে বিশেষ যত্ন। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এ সময়ের করণীয় জানালেন আরফাতুন নাবিলা

স্কুল এজের ক্লাস ফোরের শিক্ষার্থী জারাহ বাড়িতে ইদানীং ভালো লাগে না। ছোটখাটো বিষয়ে জেদ ধরে। সময় কাটানোর অবলম্বন বলতে শুধু গ্যাজেট। ইউটিউবে ভিডিও দেখা বা গেম খেলাই তার সারা দিনের কাজ। অনলাইন ক্লাস ও হোমওয়ার্ক নিয়ে খুব অল্প সময়ই কাটে। ঘুরেফিরে আবারও সেই গ্যাজেট নিয়েই কাটানো। টানা স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তার মানসিক আচরণে পরিবর্তন এসেছে। জারাহর মা খাদিজা তাহেরা জানালেন, ‘স্কুল চলাকালীন যতটুকু গ্যাজেট আসক্তি ছিল, এখন তার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। পড়াশোনার আগ্রহ দিন দিন কমেছে। এখন শুধু স্কুলে যেতে চায়। বন্ধু, ক্লাস, খেলাধুলা সবকিছু মিস করে। মাঝেমধ্যে আমি রান্নার কাজে ওকে সঙ্গে নেই। শুরুতে কিছুদিন বই পড়ত। এখন সেটাও করে না।’

এ সমস্যা শুধু জারাহর একা না। স্কুল-কলেজপড়ুয়া সব শিক্ষার্থীই ভুগছে বিষন্নতা ও অস্থিরতায় । গত বছরের মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। শিশুদের শুরুর দিকে প্রবোধ দিয়ে রাখলেও এখন বাবা-মায়েরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। এতে শিশুর মানসিক চাপ বাড়ছে, ক্ষতি হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক । জেদি, একরোখা, সাহায্য করার আগ্রহ কমে যাওয়া, নিজেকে একা করে রাখা, লেখাপড়ায় মনোযোগ না থাকা এমন অনেক সমস্যায় আক্রান্ত।

বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের ইংরেজি বিষয়ের সিনিয়র শিক্ষক সৈয়দ নাজমুস সাকিব। তিনি জানালেন শিক্ষার্থীদের বদলে যাওয়ার ঘটনা। সাকিব বলেন, ‘স্কুলের থেকে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের আচরণ একদম আলাদা। অনলাইনে বেশির ভাগ সময়েই শিক্ষার্থীরা রেসপন্স করে না। মাইক্রোফোন, ভিডিও অফ করে রাখে। পরীক্ষা নিয়ে সিরিয়াসনেস নেই। অ্যাসাইনমেন্ট বাকি থাকে। ক্লাসের ভিডিও অফ রেখে অনলাইনে গেমস খেলে। অন্যকে সাহায্য করার মানসিকতা  দেখা যায় না। দেখা যাচ্ছে, মেসেঞ্জারে এক বন্ধু সাহায্য চাচ্ছে। সবাই সেটা দেখেও সাহায্য করছে না। আবার একজন ভুল টাইপ করলে সেটা নিয়েও মজা করছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে ওদের সামাল দেওয়ার কেউ নেই।

কর্মজীবী বাবা-মায়ের পরিবারে সন্তানদের সমস্যা আরো বেশি। সন্তান অনলাইনে কীভাবে ক্লাস করছে দেখার কেউ থাকছে না। শুধু শিক্ষার্থীদের একপেশে দোষ দিয়েও লাভ নেই। শিক্ষার্থীরা যেখানে সারা দিন বসে ক্লাস করতে পারছে না, সেখানে একজন শিক্ষকেরও কিন্তু ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় তিন ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। এতে শিক্ষকদের ওপরও চাপ বাড়ছে। একটানা ক্লাস, খাতা দেখা, সিলেবাস বানানো সবকিছু মিলিয়ে তাদের চাপও অনেক। সব মিলিয়ে মনে হয়, শিক্ষাপদ্ধতিতে পরিবর্তন জরুরি। যেমন বাবা-মায়ের বোঝা উচিত আমরা খুব কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। শিশুদের পড়ার জন্য মানসিক চাপ তৈরি না করে বরং সৃজনশীল কাজে বেশি যুক্ত করা উচিত। শিক্ষাব্যবস্থার নীতিনির্ধারকদের উচিত স্কুলগুলোতে ক্লাসের সংখ্যা কমিয়ে আনা। বিষয়টি এখন এমন হয়েছে যে, শিশুদের ব্যস্ত রাখতে চাইলে স্কুলে আরও কার্যক্রম বাড়িয়ে দাও। আমাদের মনে রাখা উচিত, আমরা এখন অনলাইনে। সরাসরি স্কুলে হলে যত খুশি কাজ করা যেত, একা একা সেগুলো সম্ভব নয়। শিশুদের স্কুলের পড়ায় ব্যস্ত না রেখে বরং বাড়িতে ওদের যথেষ্ট সময় দিন।’

বাড়িতে গ্যাজেট আসক্ত হওয়ায় মানসিক অবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে। চাইলেই তারা বাইরে যেতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহমেদ তুষার বলেন, ‘বড়রা নানা অজুহাতে বাইরে গেলেও ছোটরা তা পারছে না। যেসব বাড়িতে অন্যদের সঙ্গে মেশার সুযোগ আছে তাদের সমস্যা তুলনামূলক কম। কিন্তু যারা একা তাদের সমস্যা একটু বেশি। কিছু করতে ইচ্ছা না করা, ভালো না লাগা, গ্যাজেট, গেম আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে, অনলাইনে ক্লাসের প্রতি আগ্রহ কমছে। সে ক্লাসে কিছু বুঝতে পারে না। ফলে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। স্কুল তো আসলে ওদের আনন্দের জায়গা ছিল। এসব থেকে ওদের মধ্যে ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বেড়ে গেছে। চোখ, ঘাড়, মেরুদণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাতে ঘুমের নিয়ম বদলে গেছে। এসব সমস্যা একেবারে দূর করা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা তৈরি করতে হবে পরিবারের সদস্যদেরই। তাদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া, গল্প করা, ঘরের কাজ মিলেমিশে করার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গ দিতে হবে।’

শিশুদের মানসিক অবস্থা শুধু ক্লাস, গ্যাজেটে আটকে খারাপ হচ্ছে এমন নয়। অনেক পরিবারে সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াও এর অন্যতম কারণ। করোনায় বহু পরিবারে আয় কমে গেছে। চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। হতাশা নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পেরে শিশুদের ওপর চলছে অত্যাচার। একে তো শিশুরা ঘরবন্দি, তার ওপর পরিবারে হতাশা, ক্ষোভ এসব দেখে তারা আরও অসুস্থ হচ্ছে। সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়া নিয়ে এনাম মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের প্রধান ডাক্তার ফারুক হোসাইন বলেন, লকডাউনে বাচ্চাদের প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এর কারণ মূলত ডিপ্রেশন, দুশ্চিন্তা, হতাশা। অনেক পরিবারে একমাত্র রোজগার করা বাবাও চাকরি হারিয়েছেন। সেসব পরিবারে হতাশা, দুশ্চিন্তা বেড়েছে। দুশ্চিন্তা বাড়লে মানুষের মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ছে বাচ্চাদের ওপর। আবার বাচ্চারাও বাসায় থেকে একঘেয়ে হয়ে গেছে। বড়রা কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারলেও ছোটদের সেই দক্ষতা নেই। তারা বাবা-মাকে নিজেদের একঘেয়েমি থেকেই কিছুটা বিরক্ত করে। এতে বড়রা বিরক্ত হয়ে ছোটদের গায়ে হাত তুলছে, বকা দিচ্ছে। এটা আগে যতটা ছিল, এখন এর পরিমাণ বেড়ে গেছে। বাবা-মাও কিন্তু আমাদের কাছে এসে এটা স্বীকার করছেন যে তাদের মেজাজ ভালো থাকছে না। তারা রেগে যাচ্ছেন। আসলে একেকজনের পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা একেক রকম। যারা ভালো করছে, তাদের সন্তান ঠিক আছে, কিন্তু যারা পারছে না সমস্যা তাদের বেশি । এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মূল পরামর্শ আমরা বাবা-মাকেই দিচ্ছি। অনলাইনে সব তথ্য বিশ্বাস না করে সঠিক জায়গা থেকে তথ্য নিতে হবে। ঘন ঘন খবর দেখে উদ্বিগ্ন হওয়া যাবে না। মানুষ মারা যাচ্ছে, অক্সিজেন নেই, আক্রান্ত হচ্ছে এসব খবর শুনে নিজেরা অসুস্থ হওয়া যাবে না। আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সরাসরি দেখা না হলেও অনলাইনে যোগাযোগ রাখতে হবে। কেউ ভালো কিছু শুনলে সেটা আরেকজনকে জানাতে হবে। খারাপ খবর শুনলে যে ভালো বোঝে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সত্যিটা জানার চেষ্টা করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি বিষয় পর্যাপ্ত ঘুম, খাওয়া-দাওয়া সব ঠিক রাখতে হবে। বাড়িতে সুস্থ বিনোদন, ছেলেমেয়েদের নিয়ে নতুন কিছু শেখার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বাচ্চারা আর বিরক্ত করবে না। এতে বড়-ছোট কারও ওপরই মানসিক চাপ পড়বে না।’

সন্তানের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটালে আসলেই যে তার মধ্যে পরিবর্তন সম্ভব সে বিষয়ে সরাসরি প্রমাণ পেয়েছেন অভিভাবক সজল জাহিদ। সন্তান আয়ান আবদুল্লাহ বিএফ শাহীন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। করোনার আগে তাদের বাসায় কোনো নেট কানেকশন ছিল না। টিভিতে কার্টুন দেখা, খেলাধুলা আর গল্পের বই পড়েই অবসর কাটত আয়ানের। অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে সে ইন্টারনেট, গেমস, ফেইসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, টিকটিক সব চিনেছে। বন্ধুদের সঙ্গে আলাদা গ্রুপ চ্যাটে তার এখন কথা হয়। এ ছাড়া তার আচার-আচরণ, কথাবার্তা, চালচলন আর ব্যবহার সবকিছুতেই বদল এসেছিল। বাবা সজল জাহিদ চোখের সামনে ছেলের এমন পরিবর্তন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ছিলেন। সবচেয়ে খারাপ বিষয় ছিল, লেখাপড়া, পরীক্ষা নিয়ে তার মধ্যে আগ্রহ কাজ করেনি। এ ছাড়া সাধারণ যত শিক্ষা তার মধ্যে ছিল সেসবও সে বেমালুম ভুলে যাচ্ছিল।

বাবা হিসেবে তিনি বুঝলেন ছেলেকে সময় দিতে হবে। তিনি নিজের কাজের সঙ্গে ছেলেকে যুক্ত করে নিলেন। ছেলেকে নিয়ে ব্যায়াম করলেন, ছাদে বাগান পরিচর্যার সময় ছেলেকে সঙ্গে নিলেন, একসঙ্গে সিনেমা দেখলেন, ছেলেকে বললেন তার পছন্দের বই পড়ে শোনাতে। এভাবে দিনের অনেকটা সময় তাকে ব্যস্ত করে রাখলেন। তার মতামত নিয়েই একটা রুটিন করে দিলেন। যার ফলাফল ছেলের পরিবর্তন। বাবা বুঝতে পারলেন, এই কঠিন সময়ে সবচেয়ে জরুরি সন্তানকে সময় দেওয়া। সিদ্ধান্ত নিলেন এখন থেকে সব সময় ছেলের জন্য যেভাবেই হোক সময় বের করবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *