করোনা শেষে এক নতুন পৃথিবী (প্রথম পর্ব)
মানবজাতি এখন এক সংকটের মুখোমুখি। সম্ভবত এটি আমাদের দেখা সবচাইতে বড় সংকট। আগামীর পৃথিবী কেমন হবে তা নির্ভর করছে আগামী কয়েক সপ্তাহের উপর। এই কয়েক সপ্তাহে নাগরিক এবং সরকারসমূহের নেয়া সিদ্ধন্তের ওপর। সেই সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে আমাদের আগামীর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঢেলে সাজবে। শুধু তাই নয় একই সাথে আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিও পুর্নগঠিত হবে।
জরুরি অবস্থায় অনেক স্বল্প মেয়াদী কৌশল হাতে নেয়া হয়। পরবর্তীতে সেগুলোই নিত্য দিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। যে সিদ্ধান্তগুলো নিতে স্বাভাবিক সময়ে বছরের পর বছর সময় লাগে সেগুলো তখন কয়েক ঘন্টার মধ্যে নেয়া হয়। এটাই জরুরি অবস্থার প্রকৃতি। অপরিণত, এমনকি বিপদজনক প্রযুক্তিও এইসময় ব্যবহার করা হয়। কারণ হাত গুটিয়ে বসে থাকার বিপদ আরো বেশি। এমন সময়ে বড় মাত্রার সামাজিক পরীক্ষা চলতে থাকে। রাষ্ট্রসমূহ সেই পরীক্ষার গিনিপিগে পরিণত হয়। কী ঘটে, যখন সবাই ঘরে বসে কাজ করে অথবা শুধুমাত্র দূর থেকেই যোগাযোগ করে? কেমন হয়, যখন সকল শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে হয়? স্বাভাবিক সময়ে রাষ্ট্র, ব্যবসা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই ধরণের এক্সপেরিমেন্টে কখনোই রাজি হবে না। কিন্তু এখন সময় স্বাভাবিক নয়।
এই সংকটকালে আমাদেরকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেছে নিতে হবে। একটি হলো, আমরা কি কর্তৃপক্ষের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে থাকতে চাই নাকি নাগরিক ক্ষমতায়ন চাই। অপরটি হলো, আমরা কি বিচ্ছিন্ন জাতীয়তাবাদী হতে চাই নাকি সকল দেশের মধ্যে একতা চাই।
শিরায় শিরায় নজরদারি
চলমান মহামারীটি বন্ধ করতে হলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলতে হবে। দুটি উপায়ে এই নিয়মগুলো মানা সম্ভব। একটি হলো, সরকার জনগণের ওপর নজরদারি করবে এবং যারা নিয়মভঙ্গ করবে তাদেরকে শাস্তি দিবে।
আজ মানব ইতিহাসে প্রথম বারের মতো প্রযুক্তির সাহায্যে সকল মানুষকে সার্বক্ষণিক নজরাদারি করা সম্ভব হয়েছে। ৫০ বছর আগে কেজিবি ২৪০ মিলিয়ন সোভিয়েতবাসীকে ২৪ ঘন্টা নজরদারিতে রাখতে পারেনি। সংগৃহীত সকল তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারবে এমন আশাও তারা করেনি। কেজিবি তাদের এজেন্ট এবং বিশ্লেষকদের উপর নির্ভরশীল ছিলো। আবার একজন এজেন্ট দিয়ে সব নাগরিককে নজরদারির আওতায় আনাও সম্ভব ছিলো না। কিন্তু এখনকার দিনের সরকারগুলো রক্ত মাংসের এজেন্টের পরিবর্তে সর্বব্যাপী সেন্সর ব্যবহার করছে। ব্যবহার করছে শক্তিশালী অ্যালগরিদম।
সারা দুনিয়ায় করোনভাইরাস মহামারীর বিরুদ্ধে এখন যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে বেশ কয়েকটি সরকার নজরদারির নতুন সরঞ্জাম ব্যবহার শুরু করেছে। এদের মধ্যে যার কথা না বললেই নয় সেই দেশটি হলো চীন। চীনা কর্তৃপক্ষ সেন্ট্রাল ডাটাবেজ সেন্টার থেকে সকল নাগরিকদের স্মার্টফোন কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। ব্যবহার করেছে লক্ষ লক্ষ ফেস রিকগনিশন ক্যামেরা। সকল জনগণকে তাদের শরীরের তাপমাত্রা ও অন্যান্য শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করে অনলাইনে জানানোকে বাধ্যতামূলক করেছে। এর ফলে তারা খুব দ্রুততার সাথে করোনাভাইরাস বাহকদের শনাক্ত করেছিল। কিন্তু একই সাথে তারা প্রত্যেকটি নাগরিকের গতিবিধি ট্র্যাক করতে পেরেছিল। নাগরিকরা কে কার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করেছে, কে কার সংস্পর্শে এসেছে তাও জানতে পেরেছিল।
এই জাতীয় প্রযুক্তি শুধু পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়। ইসরাইলের এমন কিছু নজরদারি প্রযুক্তি আছে যা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে সংরক্ষিত। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি করোনভাইরাস রোগীদের খুঁজে বের করতে সেই প্রযুক্তিগুলো ব্যবহারের জন্য ইসরাইল সিকিউরিটি এজেন্সিকে অনুমোদন দিয়েছেন। সংসদীয় উপকমিটি এটি অনুমোদন দিতে অস্বীকৃতি জানালে নেতানিয়াহু একটি জরুরি আদেশ জারি করে এটির অনুমোদন দেন।
আপনি যুক্তি দিতে পারেন যে এগুলো তো নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উভয়ই জনগণের গতিবিধি দেখার জন্য এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আরও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসছে। তবুও এই মহামারীটি নজরদারির ইতিহাসেও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে। যে দেশগুলি এখন পর্যন্ত গণ নজরদারি প্রত্যাখ্যান করে আসছিল তারা স্বাভাবিকভাবে গণ নজরদারি সরঞ্জাম স্থাপন করবে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর হলো, এটি উপর থেকে নজরদারির পরিবর্তে এখন শিরায় শিরায় নজরদারি করবে।
এতোদিন যাবত আপনার আঙুলটি যখন আপনার স্মার্টফোনের স্ক্রিনটি স্পর্শ করে এবং একটি লিংকে ক্লিক করে, তখন সরকার আপনার আঙুলটি ঠিক কী ক্লিক করছে তা জানতে চেয়েছিল। তবে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সরকারের এই জানতে চাওয়ার বিষয় বদলে গেছে। এখন সরকার আপনার আঙুলের ত্বকের তাপমাত্রা এবং তার নিচে আপনার ধমনী – শিরার রক্তচাপও জানতে চায়।
(চলবে)
মূল: ইউভাল নোয়াহ হারারি
অনুবাদ: ডা. নাজিরুম মুবিন
চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা