করোনা শেষে এক নতুন পৃথিবী (পর্ব-২)

আমরা এখন নজরদারির কোন ধাপে আছি সেটা খুঁজে বের করা বেশ ঝামেলার। কেননা, আমরা কেউই সঠিকভাবে জানি না যে কিভাবে আমাদের উপর নজরদারি করা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতেই বা কিভাবে তা করা হবে। নজরদারি প্রযুক্তি ভয়ংকর গতিতে উন্নত হচ্ছে। ১০ বছর আগে যেটাকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী বলে মনে হতো আজ সেটা খবরের কাগজের পুরনো খবর।

একটি কাল্পনিক সরকারের কথা মনে মনে ভাবুন। যে সরকার প্রতিটি নাগরিককে একটি বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পড়তে বাধ্য করে। যা কি না দিন রাত ২৪ ঘন্টা দেহের তাপমাত্রা ও হৃৎস্পন্দনের হার পর্যবেক্ষণ করবে।

ব্রেসলেট থেকে পাওয়া তথ্য ও উপাত্তসমূহ সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তীতে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে তা বিশ্লেষণ করা হবে। এসবের ফলাফল কী দাঁড়াবে জানেন? আপনি যে অসুস্থ তা আপনি বুঝতে পারার আগে অ্যালগরিদম বুঝে যাবে।

শুধু তাই নয়, আপনি কোথায় ছিলেন, কার সঙ্গে দেখা করেছিলেন সব কিছু অ্যালগরিদমে জমা থাকবে। এই সব কিছু দিয়ে সংক্রমণের বিস্তারকে দ্রুততার সাথে কমিয়ে আনা যাবে। যুক্তি-তর্ক দিয়ে বলা যায়, এই রকম একটি ব্যবস্থা মহামারীকে কয়েকদিনের মধ্যে থামিয়ে দেয়ার সক্ষমতা রাখে। শুনতে খুব ভালো লাগছে, তাই না?

কিন্তু ভয়ের দিকটা হলো, এটি ভয়ংকর রকমের নজরদারি ব্যবস্থাকে বৈধতা দিয়ে ফেলতে পারে। যেমন ধরেন, আমি সিএনএনের পরিবর্তে ফক্স নিউজের লিংকে ক্লিক করলে আপনি আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি আমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে একটা ধারণা পাবেন। কিন্তু একটি ভিডিও ক্লিপ দেখার সময় আমার তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দনের হার কিভাবে পরিবর্তিত হয় তা যদি আপনি জানতে পারেন তাহলে কী হবে? আপনি জেনে যাবেন, কী দেখে আমি হাসি, কী দেখে আমি কাঁদি, কোন বিষয়টি দেখে আমি প্রচণ্ড রকম রেগে যাই।

এটা মনে রাখা খুব জরুরি যে, সর্দি কাশির মতো হাসি, কান্না, প্রেম, ক্ষোভও জৈবিক ব্যাপার। যে প্রযুক্তি কাশি শনাক্ত করতে পারে, সেই একই প্রযুক্তি হাসিও শনাক্ত করতে পারবে।

যদি সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাসমূহ আমাদের বায়োমেট্রিক তথ্য উপাত্ত গণহারে সংগ্রহ করতে থাকে, তাহলে তারা আমাদেরকে এতো নিখুঁতভাবে জানতে পারবে যে, আমরা নিজেরাও নিজেদের ব্যাপারে ততোটা জানতে পারব না। এর মাধ্যমে তারা শুধু আমাদের অনুভূতি অনুমান করবে তা কিন্তু নয়, তারা আমাদের অনুভূতিকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।

তাদের যা ইচ্ছা তাই আমাদের কাছে বিক্রি করবে। হোক সেটা একটা পণ্য কিংবা একজন রাজনীতিবিদ। বায়োমেট্রিক পর্যবেক্ষণ কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার তথ্য চুরির পদ্ধতিগুলোকে প্রস্তর যুগের জিনিসে পরিণত করতে পারে।

২০৩০ সালের উত্তর কোরিয়াকে কল্পনা করুন। যেখানে প্রতিটি নাগরিককে দিন রাত ২৪ ঘন্টা একটি বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট পড়ে থাকতে হয়। মনে করুন, আপনি মহান নেতার ভাষণ শুনছেন। এদিকে আপনার বায়োমেট্রিক ব্রেসলেট বলছে আপনি খুব রেগে গেছেন। তখন আপনার পরিণতি কী হবে বলে মনে হয়?

আপদকালীন সময়ে সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে আপনি বায়োমেট্রিক নজরদারিকে মেনে নিতে পারেন। বলতে পারেন জরুরি অবস্থা শেষে এটি তুলে নেয়া হবে। কিন্তু সাময়িক পদক্ষেপগুলোর একটা খারাপ দিক হলো, এই সাময়িক পদক্ষেপগুলো শেষ পর্যন্ত আর সাময়িক থাকে না। কারণ, একটার পর একটা জরুরি অবস্থা আসতেই থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, আমার দেশ ইসরাইল ১৯৪৮ সালে তার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জরুরি অবস্থা জারি করেছিলো। তখন সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে সংবাদপত্রের সেন্সরশিপ, ভূমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে পুডিং বানানোর বিশেষ নিয়মাবলী পর্যন্ত (আমি মোটেও ঠাট্টা করছি না) ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। ইসরাইল বহুদিন আগেই স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে কিন্ত তাদের জরুরি অবস্থা এখনো শেষ হয়নি।

১৯৪৮ সালে নেয়া অনেক ‘সাময়িক’ পদক্ষেপও বাতিল করা হয়নি। (দয়াপরবশ হয়ে জরুরি অবস্থায় পুডিং বানানোর বিধিটি ২০১১ সালে বাতিল করা হয়)

করোনাভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা শূন্যের কোঠায় নেমে আসলেও, তথ্যের জন্য ক্ষুধার্ত কিছু সরকার বায়োমেট্রিক নজরদারি চালিয়ে যেতে পারে। তারা যুক্তি দিতে পারে, আমরা করোনাভাইরাসের ২য় আক্রমণের আশংকা করছি। অথবা বলতে পারে, আফ্রিকায় ইবোলার নতুন জীবাণু পাওয়া গিয়েছে অথবা…বুঝতেই পারছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের প্রাইভেসিকে নিয়ে এক বিশাল যুদ্ধ চলছে। করোনাভাইরাস সংকট এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে। কারণ, জনগণকে যখন প্রাইভেসি এবং স্বাস্থ্যের মধ্যে যেকোন একটি বেছে নিতে বলা হয়, তারা সাধারণত স্বাস্থ্যকেই বেছে নেয়।

(চলবে)

মূল: ইউভাল নোয়াহ হারারি

অনুবাদ: ডা. নাজিরুম মুবিন

চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924