করোনায় বিপজ্জনক চরাঞ্চলের লাখো শিশু!
সুমন, নয়ন, শাকিল, সাকিব, ওমর, তৈয়ব, আরিফ ও ঝর্না। ওরা চরের শিশু। ব্যস্ত মাছ শিকারে। মাছ না পেলে ঘরে ভাতের জোগান হয় না। তাই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে মাছ শিকার। কখনও ব্যারজাল, কখনও বড়শি, কখনও ইলিশ আবার কখনও বা ধর্মজাল দিয়ে ওরা মাছ শিকার করে। তারপর এগুলো বিক্রি করে বাড়ি ফেরে। আবার রাতেও ওরা নদীতে পরিবারের কিংবা পড়শি বড়দের সাথে কামলা হিসাবে নদীতে অথবা ছোট জাল দিয়ে খালে মাছ ধরে। এমন জীবিকা ওদের জীবনের নিয়মে বাঁধা। সে নিয়ম ভাঙতে পারেনি বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেওয়া মহামারি করোনাভাইরাস। ওদের বাড়ি তেঁতুলিয়া নদীর বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠা চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের চর চরনিমদি।
পটুয়াখালী সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার মেটরসাইকেল পথ পেরিয়ে বাউফলের উপজেলার ধানদি খেয়াঘাট। ওখান থেকে ১০ মিনিট নৌপথে তেঁতুলিয়া নদী পাড়ি দিয়ে পূর্বদিকে তেঁতুলিয়া নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন। আর চরনিমদি হলো চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের একটি গ্রাম। পটুয়াখালী জেলার পূর্ব উত্তরের শেষ ইউনিয়ন চন্দ্রদ্বীপ।
করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার্থে শিক্ষার্থীদের যেতে হয় না স্কুলে, ব্যাংক, বিমা বন্ধ। হাটবাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধপ্রায়। বন্ধ কলকারাখানাও। সরকারের এমন ঘোষণা মেনে চলতে নির্দেশনা সকলকে। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় ছোটরা তো সবাই এবং বড়রাও যখন ঘরে রাখতে নিজেকে ব্যস্ত। কিন্তু সে আওয়াজ পটুয়াখালীর চরবাসীর মধ্যে সাড়া তুলতে পারেনি। করোনা পরিস্থিতির আগে কিংবা বর্তমানে চরবাসীর জীবনধারা একইরকম। সরেজমিনে এমন চিত্রই দেখা গেছে পটুয়াখালীর বিভিন্ন চর ঘুরে। আর ঝুঁকির মধ্যে থাকা শিশুদের দেখা মিলে যত্রতত্র।
শনিবার ধানদি খেয়া পার হয়ে চন্দ্রদ্বীপে পৌঁছাতেই চরনিমদি এলাকায় নজরে এলো ব্যারজাল দিয়ে মাছ ধরছে থেকে ১২ জন। তাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্বের কোনো হিসেব নাই। এদের মধ্যে প্রথমে কথা হয় সুমন (৯) এর সাথে। সুমন জানায়, ওদের সংসারে আটজন সদস্য, পুরুষ সদস্য তিনজন সবাই মাছ শিকার করে। ওই মাছ বিক্রির ওপর নির্ভর করে চলে সংসার। ব্যারজাল দিয়ে আলতাফ প্যাদ্যা মাছ ধরছে। সুমন মাছ কুড়িয়ে যা পাবে সেখান থেকে ওকে একটা ভাগ দিবে ওই মাছ বিক্রির টাকা সুমন বাড়ি ফিরে অভিভাবকের হাতে তুলে দেবে। এভাবেই করোনা পরিস্থিতিতে মাছ ধরা ও বিক্রিতে সুমনের দিন চলে। শুধু সুমন একা না, ওখানে মাছ ধরায় ব্যস্ত আরো সাত শিশুর একই অবস্থা। তাদের পরিবারও শিশু সন্তানের আয়ের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সুমন জানায়, হুনছি করোনা নামের একটা রোগ আইছে। ওই রোগের তোন বাচতে অইলে ঘরে থাহন লাগে। ঘরে থাকলে তো আমরা না খাইয়া মরমু। বাচনের লইগ্যা (জন্য) মাছ ধরি। আমাগোরে করোনায় রোগে ধরবে না! অভাবের তাড়নায় অগত্যা সুমনের এমনই ধারণা। অথচ করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে শিশু সুমনের ধারণাই নাই। এর মধ্যে সুমনদের ইউনিয়নে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (গণসংক্রমণ) মাধ্যমে ১৮ বছরের একজনের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ সময় শাকিল, ওমর প্রায় একই বক্তব্য দেয় সুমনের মতো। ওরা মাস্ক চেনে। কিন্তু হ্যান্ড স্যানিটাইজারের নাম শোনেনি। মাস্ক চিনলেও তা ব্যবহার করা ওদের কাছে বিলাসিতা।
চরনিমদি পেরিয়ে প্রায় ৫ মাইল পায়ে হেঁটে দক্ষিণ চরওয়াডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত দেখা গেল যত্রতত্র শিশুর দল। তিন-চারজন জড়ো হয়ে কেউ খেলা করছে। কেউ মাছ শিকার করে নৌকা থেকে বাজারের উদ্দেশে, কেউ আবার দোকানের সামনে বসে আছে বড়দের সাথে। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে চরমিয়াজান বাজারের উত্তর পাশে ব্যারেটের খেয়াঘাট, চরমিয়াজান বাজার, আ স ম ফিরোজ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অগ্রমুখ, ওয়াডেল জৈনপুরী হুজুরের খানকার সামনে। ওখানে আতাহার নামের মধ্যবয়সী একজন বলেন, চেয়ারম্যান, চোহিদার (চৌকিদার) করোনার কতা বহুত কইছে। আমাগো চউর্যা (চরের) মাইনস্যে করোনারে ডরায় (ভয়) না। ডরাইতে যদি ঘরে ভাত থাকতে। দিন রুজি করে সবাইর সংসার চালে। ছোট বড় সবাই কামাই করে। আর কামাই বন্ধ অইলে, না খাইয়া থাকতে অইবে।
এলাকার হাসেম গাজী বলেন, আমাগো ঘরে চাউল নাই। করিনার (করোনা) লইগ্যা ঘরে বইয়া (বসে) থাকলে না খাইয়া মরন লাগবে। চেয়ারম্যান কিছু সাহায্য দিছে। ১০ কেজি চাউলে কি অয়। এক ঘরে ৮, ১০ জন কইরগ্যা খাউন্না মানুষ (৮ থেকে ১০ জন খাওয়ার মানুষ) ১০ কেজি চাউল দুই দিনও অয় না। পোলাপানরে (শিশুদের) লইয়া কামাই না করলে সব ঘরেই না খাইয়া থাকপে লোকজনে। প্যাডের পেটের) জ্বালা সয় না। এই লইগ্যা (এ জন্য) চরের ছোড বড় সবাই কাম করে। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিলেন চরমিয়াজানের শাহ আলম, চরওয়াডেলের খোরশেদ গাজী, চর রায়সাহেবের শাহীন হাওলাদার।
এদিকে চন্দ্রদ্বীপ পৌঁছার পূর্বে বাউফল সদরের গুলশানপাড়া এলাকায় দেখা যায় ঘরের মধ্যে বন্দি অবস্থায় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ১২ বছরের এক শিশু মুকিবুল ইসলাম মাহি। নানা প্রশ্নের জবাবে মাহি জানায়, করোনাভাইরাস এর কারণে স্কুল বন্ধ। খেলাধুলাও বন্ধ। প্রায় এক মাস পর্যন্ত ঘরেই থাকি। ৫০ থেকে ২০০ গজের মধ্যে মাহির পাঁচজন বন্ধুর বাড়ি। কিন্তু ওই একমাস পর্যন্ত কারো সাথে দেখা নেই। অথচ চরের শিশুরা সকালে ঘর থেকে কর্মক্ষেত্র, সেখান থেকে বাজার, তারপর বাড়ি ফেরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পটুয়াখালীর বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা, কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালীর চরাঞ্চলে কয়েক কয়েক হাজার ব্যক্তি করোনার হটস্পট নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা থেকে এসেছে। বুধবার চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের রায়সাহেব গ্রামে ১৮ বছরের একজন করোনা পজিটিভ হয়েছে। বাউফল ১০ জন, দশমিনা তিনজন, রাঙ্গাবালী চারজন, গলাচিপায় দুজন, কলাপাড়ায় একজনসহ জেলায় মোট ২৭ জনের করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে।
চন্দ্রদ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক আলকাস মোল্লা বলেন, চন্দ্রদ্বীপে ২৫০০ পরিবার। ৯৫টি পরিবার দিনের রোজগারের ওপর নির্ভরশীল। এ পর্যন্ত ৭০০ পরিবারকে ১০ কেজি করে ত্রাণের চাল দিয়েছি। তা-ও ২, ৩ দিন পর সে চাল শেষ হয়ে যায় তাদের। করোনা পরিস্থিতিতে সব মানুষদের ঘরমুখী করে রাখতে হলে প্রায় প্রতিটি পরিবারকে পর্যাপ্ত ত্রাণ দিতে হবে। তাহলে চরের মানুষকে ঘরবন্দি করে সম্ভব। মূলত অভাবের কারণে চরের ছোট-বড় সবাই দিন রাত কাজ করে।
একই চিত্র চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়ন থেকে প্রায় ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট নৌপথে দশমিনা উপজেলার চর হাদিতে। ওখানেও মানছে না কেউ সামাজিক দূরত্ব। ঘরে নেই কেউ, সংসারের অভাব তাড়াতে সবাই পেশায় ব্যস্ত। ওই চরের লোকজনও জেলে পেশার ওপর নির্ভরশীল। ওই চরের আসমত আলী (৪৫) নামের একজন বলেন, আমার তিন পোলা দুই মাইয়া। রিয়াজ (১১), জুয়েল (১৪) এবং মঞ্জু (৮)- ওরা সবাই কাজ না করলে সংসার চলে না। আমার লগে নদীতে মাছ ধরে। আবার বড় পোলারে মাছ লইয়া বাজারে পাডাই (পাঠানো হয়)।
রাঙ্গাবালী উপজেলার সাগরপাড়ের একটি ইউনিয়ন চর মোন্তাজ। ওই ইউনিয়নের সিংহভাগ মানুষ নিম্ন আয়ের। এখানের শিশুরাও সংসারে পরিবারের সহযোগি আয়ের সদস্য। তাদেরই একজন মো. রাকিব মৃধা (১১)। সংসারে ভাতের জোগান দিতে বাড়ি থেকে রবিবার সবজি নিয়ে মোন্তাজ স্লুইস বাজারে এসেছে। অনেক মানুষের সান্নিধ্যে গিয়ে সবজি বিক্রি করে আবার বাড়ি ফিরে রাকিব। রাকিবের মতো জাহিদ, মনির এবং মর্তুজা সবজি নিয়ে বাজারে এসেছে। করোনাভাইরাস অন্যদের মাধ্যমে রাকিব, জাহিদ, মনির এবং মর্তুজাকে ছুঁয়ে যাবে কি-না সে ভাবনা নাই ওদের। বাজারে প্রতিদিন রাকিবদের আগমন হয় বিভিন্ন কাজের ছলে। প্রতিদিন স্লুইস বাজারে অসংখ্য শিশুদের দেখা মেলে যারা বাজারে বিক্রেতা এবং ক্রেতা হয়ে আসে। রাকিব জানায়, দুগ্যা ভাত খাইতে অইলে বাজারে না আইয়া উপায় নাই। আমরা হাক-পাতা, মাছ না বেইচ্চা চাউল কেনতে পারি না। আমরা কেমনে ঘরে থাকমু। করোনা আমাগো ধারে আয় না।
চরমোন্তাজ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হানিফ মিয়া বলেন, প্রায় সাত হাজার খানা রয়েছে এ ইউনিয়নে। প্রায় তিন হাজার পরিবারের হাতে সরকারি বিভিন্ন ধরনের সাহায্য দিতে পেরেছি। এখানে অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ। অধিকাংশ পরিবারে জনসংখ্যাও বেশি। তাই সাহায্য যা দরকার সে পরিমাণে বরাদ্দ নেই। আমার ইউনিয়নের চাহিদার বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। অভাবের কারণে চরের পোলাপানরা সামাজিক দূরত্ব কিংবা বাড়িতে থাকার নিয়ম মানে না।
পটুয়াখালী চরাঞ্চলের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘদিন কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্পিড ট্রাস্ট এর প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হেমায়েত উদ্দিন বলেন, লক্ষাধিক শিশুর বসবাস বাউফল, দশমিনা, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালীর চরাঞ্চলে। এককথায় এসব চরের অধিকাংশ মানুষ নিম্ন আয়ের। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ করোনা বিস্তাররোধে চরের প্রতিটি পরিবারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ত্রাণসহ অন্যান্য সহায়তা দেওয়া উচিত। যাতে তাদের ঘরবন্দি কিংবা কমিউনিটি ট্রাসমিশন বন্ধ করা যায়। প্রয়োজনে কাজটি সরেজমিনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গিয়েও করতে পারে। আর ঘরে চাল থাকলে চরের শিশুদের আটকে রাখা সম্ভব। এ ছাড়া সরকারের প্রণোদনার বিষয়টিও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেওয়া উচিত। তবেই শাসন ব্যবস্থার প্রতি ওদের মূল্যবোধ বাড়বে এবং সব সময় সরকারের সব ধরনের তথা ওরা শুনবে।
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক মো. অহিদুজ্জামান শামীম বলেন, কভিড-১৯ সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এ ভাইরাস শিশুদের মাধ্যমে খুব দ্রুত এবং বেশি মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। কারণ সাধারণত ১৮ বছর বয়সীদের কোমোরবিডিটি বা দীর্ঘমেয়াদি রোগ নেই ফলে তাদের দীর্ঘমেয়াদি ওষুধ খেতে হয় না। এ কারণে এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। তাই শিশুরা করোনায় আক্রান্ত হলে এদের উপসর্গ তেমন দেখা না-ও যেতে পারে। ফলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে নীরব ঘাতকের মতো অবাধে চরের শিশুরা কাজের মধ্যেমে লোকসমাগমে যাতায়াত করলে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটবে। শিশুদের মাধ্যমে খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি হতে পারে। করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্বসহ চরের শিশুদের জীবনমানে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া উচিত সবার।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল আলম চৌধুরী বলেন, করোনা প্রতিরোধে পটুয়াখালীকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। জেলার চরাঞ্চলগুলোতে নিম্ন আয়ের মানুষের সংখ্যা বেশি এ কারণে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে এবং আরো দেওয়া হবে। করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে প্রচার প্রচারণা চালানো হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। এটি আপাতত আমরা চলমান প্রক্রিয়া হিসাবে নিয়েছে। চরাঞ্চলে শিশুসহ যারা কাজের মধ্যে রয়েছে (কৃষি, জেলে) তাদের আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজ ও চলাচলের জন্য নিয়মিত বলে আসছি।