করোনায় ঘরবন্দি শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে
করোনায় বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও ঘরবন্দি শিশুর মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিরাজ করছে একটা দম বন্ধ পরিবেশ। শিশুরা বাইরে বের হতে পারছে না, বের হলেও নাম-মুখ ঢেকে বাইরে যেতে হচ্ছে। কারো সঙ্গে মিশতে পারছে না। বন্ধ হয়ে গেছে প্রিয় স্কুলে যাওয়া। আর কখনো স্কুলে যেতে পারবে কি না, তাও জানে না। প্রিয় বন্ধু সহপাঠীদের সঙ্গে খুনশুটি বা আনন্দ করতে পারছে না। এভাবে থাকতে থাকতে শিশুদের ভেতরে একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা তারা গুছিয়ে বলতেও পারছে না। দৈনন্দিন জীবনে শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এই শূন্যতা একটা বিরাট নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন শিশু বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, শিশুর বেড়ে ওঠা ও শৃঙ্খল জীবন গঠনে একটি রুটিনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এতে ঐ শিশু জানবে যে, এ সময় তাকে এই কাজ করতে হবে। আর রুটিন মতো কোনো কাজ না থাকলে তার জীবন অগোছালো হবে। সে ঘুরে-ফিরে মোবাইল ফোনে গেমস খেলবে বা তার পছন্দের অন্যকিছু করবে। যে কারণে শিশুর বাসায় একঘেয়ে জীবন কাটবে। তাই শিশুর সঙ্গে পরার্মশ করে একটি রুটিন করার কথা বলেন তারা। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের ঠেকাতে গত বছর মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই অভিভাবকেরা শিশুদের ঘরে রাখার চেষ্টা করছেন। ফলে শিশুদের বদলে যাওয়া জীবনযাপনে নানা সমস্যা ও সংকট দেখা দিচ্ছে। এতে শিশু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বেড়েছে। দীর্ঘদিন স্কুলের মাঠে বা ফাঁকা জায়গায় বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে ছোটাছুটি নেই। চার দেয়াল বন্দি শিশুর অপরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং ডিজিটাল ডিভাইসে মগ্ন থাকায় স্থূলতা বাড়ছে। যা অসুস্থতার পর্যায়ে ঠেলে দিচ্ছে শিশুদের। তারা বলছেন, খাদ্যাভ্যাসের অনিয়ম আর শারীরিক পরিশ্রমের অভাব শিশুদের ঠেলে দিচ্ছে স্থূলতার দিকে। অতিরিক্ত মোটা শিশু-কিশোররা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও মোটা থেকে যায়, এতে পরবর্তী সময়ে তাদের কার্ডিও ভাসকুলার, জয়েন্টের সমস্যা বা বিষণ্নতার মতো অসুখ দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। লকডাউনে বাইরে কাজ না থাকায় পরিবারের রান্না, খাওয়াদাওয়া বা গল্প করার মতো কাজগুলো মিলেমিশে করা উচিত, এসবই বাচ্চাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে ওজন কমাতে সহায়তা করতে পারে।
এদিকে করোণামুক্ত থাকতে ব্যায়ামের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সেই চাহিদা মেটাতে গিয়ে মুটিয়ে যাচ্ছে শিশুরা। এভাবে শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির মধ্যে পড়ছে। এছাড়া অনেক বাবা-মা আদর করে সন্তানরা যা খেতে চায়, তাই খাওয়ান। ফাস্টফুড ও সফট ড্রিঙ্কের মতো নানা অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ান অভিভাবকরা। অনেক অভিভাবক সন্তানদের শান্ত রাখতেও খাবার দিয়ে বসিয়ে রাখেন টিভি বা গেমস খেলতে। এতে শিশু মুটিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। অনেক অভিভাবক তার সন্তানের স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বললে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। কেননা শিশুর বেশি ওজন যে অসুস্থতা ডেকে আনতে পারে এ বিষয়ে অনেক অভিভাবকের ধারণা নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. সাকিল আহম্মদ বলেন, শিশুরা দেশের সম্পদ, তাই শিশুদের মানসিক-শারীরিক পরিচর্যা প্রয়োজন। শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতে দৌড়ানো ও শারীরিক অ্যাক্টিভিটিস বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, শৃঙ্খল জীবনে অস্থিরতা কম থাকে। তাই দিনে-রাতে কোনো কাজ করবে, তা শিশুর সঙ্গে আলোচনা করে একটা রুটিন তৈরি করতে হবে। কোনো কিছু অনলাইনে অর্ডার করলে, তাও তার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, এতে শিশুর সময় কাটবে। তাছাড়া ডিজিটাল মাধ্যমে খেলারও একটা সময় আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক থেকে দুই বছরের শিশুর জন্য ‘স্ক্রিনটাইম’ কোনোভাবেই শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপযুক্ত নয়। দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুর জন্য ‘স্ক্রিনটাইম’ হবে দুই ঘণ্টার নিচে। এ সময়েও বাবা-মা পাশে থেকে তাকে শেখাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শাহজাদা সেলিম বলেন, বর্তমানে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে এই স্থূলতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেননা শিশুরা এখন মাঠে খেলাধুলার সুযোগ পাচ্ছে না। টেলিভিশন, ভিডিও গেম আর কম্পিউটারে সময় কাটায়। অনেক শিশু বিশেষ করে উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা আঁশযুক্ত খাবার, শাকসবজি, ফলমূল খেতে চায় না। ফাস্টফুড, চকলেট, কোমলপানীয়, ফলের রস বেশি খায়। তবে শিশুর জীবনযাপন পরিবর্তনে মা-বাবার সচেতনতাই স্থূলতাকে প্রতিরোধ করতে যথেষ্ট।