শিশুদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন

আজ বিশ্ব বই দিবস। এ বছর ১০০টির অধিক দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব বই দিবস। বই পড়া এমন একটি সুন্দর অভ্যাস যা শুধু বাচ্চাদের মেধা বাড়িয়ে তোলে না, তাদের ব্যাক্তিত্ব গঠন করতেও অনেক খানি ভূমিকা নেয়। এটি বাচ্চাদের চিন্তাশক্তিকে যেমন উন্নত করে তেমনই তাদের সৃজনশীলতাকেও বাড়াতে সাহায্য করে। এই কারনেই বিশেষজ্ঞরা শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাসের উপর জোর দিয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমানের বাস্তব চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন। সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ শিশু দ্রুত ও সঠিকভাবে পড়তে সক্ষম নয়

আপনি যদি চান আপনার সন্তানের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে তাহলে সবার আগে তাদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করুন। পাশাপাশি তাকে বই পড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠতে সাহায্য করুন। আপনাদের জন্য রইল এমন কতকগুলি টিপস যা অনুসরণ করে আপনি বাচ্চার মধ্যে সুন্দর পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারবেন।

আপনিও শিশুর সঙ্গে বই পড়ায় যোগ দিন: ভালো অভ্যাস হোক বা মন্দ, মনে রাখবেন একেবারে শুরুতে বাচ্চার যা কিছুই শিখুক না কেন তা কিন্তু পরিবারের সদস্যদের থেকেই শেখে। যদি বই পড়ার অভ্যাসের কথা আসে সেক্ষেত্রেও নীতির পরিবর্তন হয় না। আপনি যদি সন্তানের মধ্যে এই অভ্যাস গড়ে তুলতে চান, তাহলে অভিভাবক হিসাবে আপনার প্রথম কাজ আপনার নিজের মধ্যে সেই একই অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রাথমিক ধাপে আপনিও বাচ্চাদের সঙ্গে বই নিয়ে বসুন। কোন গল্প বা কবিতা আপনি আগে তাকে পড়ে শোনান এবং তারপর সন্তানকেও পড়তে বলুন। এই ধরণের অনুশীলন আপনার সন্তানের মধ্যে শব্দের ভাণ্ডার তৈরিতে এবং ভাষার দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

বই বাছাই করুন: অনেক সময় শিশুরা বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ বইগুলো তাদের বয়স উপযোগী হয় না। তাই সঠিক বইটি বাছাই করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। শিশুর বয়স যদি ৪-৫ বছরের নিচে হয় তা হলে এমন বই কিনুন যেখানে একটি পৃষ্ঠায় ৩-৪ লাইন করে থাকে। ছোট শিশুদের জন্য আরও কম লাইন হলে ভালো হয়। কালারফুল বই হতে হবে অবশ্যই। লেখার ভাষা হতে হবে খুব সহজ।

বাচ্চাদের পড়ার জন্য পর্যাপ্ত বই রাখুন: বই পড়ার সুঅভ্যাস গড়ে তুলতে হলে ভালো ভালো বই তাঁর হাতে আপনি তুলে দিন। বইয়ের সেলফ এ ভালো বই রাখুন। যখনই পর্যাপ্ত বই তাদের হাতের কাছে থাকবে, নিজে থেকেই তারা আরো বেশি বই পড়ার দিকে ঝুঁকে পড়বে। তবে এমন বই বেঁছে নেবেন না যা আপনার সন্তানের বোঝার  জন্য কঠিন। এমন বই রাখুন যা তাঁর বয়সের উপযোগী এবং মনোযোগের জন্য প্রাসঙ্গিক।

ছোটখাটো দিকগুলি খেয়াল রাখুন: সন্তান একদিনেই মনোযোগী পাঠক হয়ে উঠবে না। ছোট ছোট জিনিস দিয়ে শুরু করুন। যেমন- আপনি সন্তানের সঙ্গে বসে টিভি দেখছেন, স্ক্রিনে কোন লেখা আসলে তাকে সাধ্য মত পড়তে বলুন বা ধরুন বাড়িতে খবরের কাগজের হেডলাইন গুলি তাকে জোরে জোরে পড়ে ফেলতে বলতে পারেন।

আপনি যখন বই কিনতে যাচ্ছেন, শিশুকেও সঙ্গে নিন: বই কিনতে যাওয়ার সময় আপনার সন্তান কে সঙ্গে নিন। খেলনার দোকানে সাজানো জিনিস যেমন বাচ্চাদের আকৃষ্ট করে, ঠিক তেমন ই বইয়ের দোকানের বইগুলিও কিন্তু বাচ্চাদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। বইয়ের দোকানে যাতায়াত করতে করতে রঙ- বেরঙ্গের মলাট, বইয়ের প্রচ্ছদ, ভিন্ন ভিন্ন নাম এগুলির দ্বারা ও বাচ্চারা আকৃষ্ট হতে শুরু করবে। ফলে তাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ ও তৈরি হবে।

শিশুকে লাইব্রেরিতে নিয়ে যান: ই বুক, অডিও বুকের প্রতিপত্তির যুগে লাইব্রেরির কথা আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। বাচ্চাদের পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার ক্ষেত্রে লাইব্রেরি একটি খুব ভালো জায়গা। বেশিরভাগ লাইব্রেরি বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে মেম্বারশিপ দিয়ে থাকে। বাচ্চাকে বাড়ির কাছাকাছি কোন লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ করে দিতে পারেন।

বাহবা দিতে ভুলবেন না যেন: কতগুলো বই সে এই মাসের মধ্যে পড়ে ফেলেছে তার ভিত্তিতে তাকে কোন পুরস্কার দিন। আপনার সন্তান যদি ইতিমধ্যেই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে আরো ভালো কোন বই উপহার দিন। এটি তাকে আরো বেশি করে পড়তে আগ্রহী করবে।

প্রযুক্তির সাহায্য নিন:
এক সময় ছিল যখন বাবা মায়েরা ভেবে অস্থির হয়ে যেতেন কীভাবে সন্তানের মধ্যে পড়ার ঝোঁক তৈরি করবেন। এখন সেই সময় অতীত হয়েছে। প্রযুক্তি আমাদের সামনে তথ্যের সুবিশাল ভাণ্ডার  প্রস্তুত রেখেছে যাতে বিভিন্ন ভিজুয়াল টুলের পাশাপাশি ই-বুক, অডিও বুক ইত্যাদির সম্ভার আপনি পাবেন। বাচ্চার মধ্যে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে এগুলো কে কাজে লাগান।

গল্পের বই তাকে পড়ে শোনান: শিশুর বয়স যদি ২-৬ বছরের মধ্যে হয়, তা হলে নিয়ম করে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে একটি করে গল্পের বই তাকে পড়ে শোনান। সারা দিন নানা কাজ করে ক্লান্ত শরীরে হয়তো ভাবেন একটু বিশ্রাম নেবেন। কিন্তু ভেবে দেখুন প্রতিদিন কিন্তু শিশু ঘুমের সময় আপনি তার সঙ্গেই শুয়ে সাধারণত ঘুম পাড়ান। এই কাজটিই এখন শুধু করুন– কেবল ঘুমানোর আগে ১৫ মিনিট হলেও একটি বই তাকে পড়ে শোনান। এতে করে তার স্মার্টফোন বা কার্টুনের প্রতি আকর্ষণ কমতে থাকবে এবং আপনিও শিশুর সঙ্গে চমৎকার কিছুটা সময় কাটাতে পারবেন।

জন্মদিনে বই উপহার দিন: শিশুর জন্মদিনে বেশিরভাগ অভিভাবক খেলনা উপহার দিয়ে থাকেন। তবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে চাইলে ছোটবেলায় শিশুর জন্মদিনে বই উপহার দিন। এতে করে আপনার সন্তানও বইয়ের প্রতি আপনি যে অনেক গুরুত্ব দিচ্ছেন সেটি বুঝবে এবং ধীরে ধীরে নিজের মধ্যেও বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে।

 শিশুর মনে প্রশ্ন জাগ্রত রাখুন: শিশুরা একটু বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সব কিছু নিয়ে জানতে চায়। তার চোখে থাকে রাজ্যের বিস্ময়। এ সময় আপনার কাজ হবে তার জানতে চাওয়া প্রশ্নের ক্রমাগত উত্তর দেয়া। এখানে লক্ষ্য রাখার বিষয় হচ্ছে- তার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে যেন আপনি ক্লান্ত হয়ে না যান। এবং রেগে গিয়ে তাকে ধমক না দেন। আপনি তার এই উৎসুক মনটার সাহায্য নিয়েই তার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক জুড়ে দিতে পারেন খুব ছোট বয়সেই!

বই না পড়লে কল্পনাশক্তির বিকাশ হবে না। আর কল্পনাশক্তি সঙ্গে নিয়ে আসে নতুন নতুন ধারনা, যা সৃজনশীলতার উৎস। তাই বই পড়ার মত অভ্যাস সন্তানের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই গড়ে তোলার চেষ্টা করুন।

উল্লেখ্য যে, ১৯৯৫ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে ইউনেস্কোর উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হয়। বই দিবসের মূল উদ্দেশ হলো—বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো। বিশ্ব বই দিবসের মূল ধারণাটি আসে স্পেনের লেখক ভিসেন্ত ক্লাভেল আন্দ্রেসের কাছ থেকে। ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান স্পেনের আরেক বিখ্যাত লেখক মিগেল দে থের্ভান্তেস। আন্দ্রেস ছিলেন তার ভাবশিষ্য। নিজের প্রিয় লেখককে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে আন্দ্রেস স্পেনে পালন করা শুরু করেন বিশ্ব বই দিবস।এরপর ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে বিশ্ব বই দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং পালন করতে শুরু করে। সে থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্ব বই দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Warning: Undefined array key 0 in /home/freevec2/bdchild24.com/wp-content/plugins/cardoza-facebook-like-box/cardoza_facebook_like_box.php on line 924